একদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-উন্মাদনা, সেই ভিনরাজ্যে বিশেষ করে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে কাজ করতে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চলার পাশাপাশি খোদ পশ্চিমবঙ্গেই চলছে মবলিঞ্চি-এর মতো ঘটনা। যদিও এই ঘটনা ভারতের অনেক রাজ্যেই ঘটছে। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদে জিয়াগঞ্জে এক দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র রহমতুল্লাহকে মাংস বিক্রির জন্য মবলিঞ্চিং- এর শিকার হতে হয়। অন্যদিকে তার রেশ কাটতে না কাটতে শিয়ালদহ -লক্ষীকান্তপুর শাখায় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে ট্রেনের মধ্যেই প্রকাশ্যে মবলিঞ্চিং- এর শিকার হতে হয়। লক্ষীকান্তপুরেই(দক্ষিণ ২৪ পরগণা) ঘটনাটি ঘটেছে। ঐ ছাত্রের নাম সানাউল্লাহ। এই ঘটনায় স্থানীয় এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
এদিকে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে ভগবানগোলার ছাত্র রহমতুল্লাহর পরিবার জানান, গত রবিবার (১১ মে) মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে ভগবানগোলার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র রহমতুল্লাহকে ঘোষেরা গো-মাংস বিক্রির জন্য গণপিটুনি দেয়। ফলে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে সে এখন বাড়িতে শয্যাশায়ী। জিয়াগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়েছে জিয়াগঞ্জের ভট্টপাড়ার পাঁচ জনের বিরুদ্ধে। পুলিশ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ১২ মে থানায় সর্বদলীয় সভা করেছে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় তার জন্য।
রহমতুল্লাহর বাড়ি ভগবানগোলা বিধানসভার মহিষাস্থলি অঞ্চলের সুবর্ণমৃগী বালি- রমনা গ্ৰামে। শিয়ালদহ-লালগোলা লাইনে সুবর্ণমৃগী স্টেশনের পূর্ব পাশের গ্ৰাম। কালুখালী হাই মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ১৯। গত রবিবার (১১ মে) সকালে সাইকেলে চড়ে গো-মাংস বিক্রি করতে গিয়েছিল জিয়াগঞ্জ শহরে। সকাল দশটা নাগাদ এনাতুলিবাগ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পলিথিনের প্যাকেটে ভরে মাংস বিক্রি করছিল । সেই সময় এনাতুলিবাগের পাশের পাড়া ভট্টপাড়ার ঘোষ সম্প্রদায়ের কুড়ি পঁচিশ জন যুবক গরুর মাংস কেন বিক্রি করছে বলে মারপিট শুরু করে। কিল ঘুষি চড় থেকে শুরু করে গাছের ডাল দিয়ে বেধড়ক মারে। স্থানীয় দু’ জন যুবক জিয়াগঞ্জ থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে উদ্ধার করে। গ্ৰামে গ্ৰামে সাইকেলে চড়ে গো-মাংস বিক্রি করা রহমতুল্লাহদের পারিবারিক ব্যবসা। গত ৩০-৩৫বছর ধরে এই ব্যবসা করছে পরিবারটি। প্রথমে করতেন রহমতুল্লাহর দাদো হাজী ইমরান সেখ, এলাকায় তিনি ইমরান কশাই বলেই পরিচিত এবং পরে তার বাবা আবদুল মাতিন সেখও এ ব্যবসা করেন। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র রহমতুল্লাহ মাঝেমধ্যে তাদের সাহায্য করতে নিজেও যায়। ঐ দিন রহমতুল্লাহ, বাবা ও দাদো তিন জনই যান মাংস বিক্রি করতে। রহমতুল্লাহ এনাতুলিবাগে মাংস বিক্রি করলেও তার বাবা ও দাদো বিক্রি করছিলেন পার্শ্ববর্তী গ্ৰামগুলিতে। রহমতুল্লাহকে যখন ভট্টপাড়ার ঘোষেরা পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল তখন পাশের গ্ৰামে থেকে তার বাবা ও দাদো সে ভয়াবহ খবর শুনতে পেলেও জীবনের ভয়ে রহমতুল্লাহকে উদ্ধার করতে ছুটে যাননি। রমনা গ্ৰামের একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে এনাতুলিবাগে। তিনিই রহমতুল্লাহকে গণপিটুনির খবর তার বাপের বাড়িতে দেন। তারা খবর দেন রহমতুল্লাহর মা-কে।
পুলিশ রহমতুল্লাহকে গণপিটুনির হাত থেকে উদ্ধার করে প্রথমে জিয়াগঞ্জ প্রাথমিক হাসপাতালে চিকিৎসা করান। পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে ছেড়ে দিলে পরিবারের লোকজন বহরমপুর মনমোহিনী নার্সিং হোম এ ভর্তি করে। চোখের সমস্যা খুব বেশি থাকায় মনমোহিনী থেকে দিশা আই হাসপাতালে ভর্তি করে।
রহমতুল্লাহর বাবা আবদুল মাতিন সেখ এফআইআর এ যাদের অভিযুক্ত করেছেন তারা হল ১. অয়ন ঘোষ, ২. মিঠুন ঘোষ, ৩. নয়ন ঘোষ, ৪. রিক সাহা, ৫. বিধু ঘোষ। সকলের ঠিকানা ভট্টপাড়া, ঘোষপাড়া, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ। ধারা দিয়েছে বিএনএস ১২৬/২, ১১৫/২, ১১৭/২, ১০৯ এবং ৩/৫।
আজ এপিডিআর এর মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মিলন মালাকার ও বন্দীমুক্তি কমিটির রাজ্য সহ-সভাপতি তায়েদুল ইসলাম রমনা গ্ৰামে রহমতুল্লাহর পরিবারের সাথে দেখা করেন। এবং প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
রহমতুল্লাহর মা ও ফুফু জানান ঘোষেরা রহমতুল্লাহকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। দু’জন ছেলে থানায় না জানালে সে মরে যেত। এনাতুলিবাগের মেয়েরা বলেছে ঘোষেরা মাঝেমধ্যেই জোর করে বাড়ি ঢুকে যায় এবং হেঁসেল ঘরে ঢুকে হাঁড়ি দেখে গরুর মাংস রান্না করেছে কি না।
এনাতুলিবাগের এক মহিলা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ঘোষেরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে হেঁশেলের হাঁড়ি পাতিল থালা বাসন পত্র সব ভাঙচুর করে, এ দিক ওদিক ছড়িয়ে দেয়। গালমন্দ করে।
রহমতুল্লাহকে যখন ঘোষেরা গণপ্রহার করতে করতে নিজেদের এলাকায় নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিন জন মহিলা সাহস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রহমতুল্লাহকে বাঁচাতে যান। তখন গণপ্রহারকারীরা মহিলাদের অশ্লীল ভাবে গালিগালাজ করে এবং বলে তোদের সব বিধবা করে দেব। সব জায়গায় মুসলিমদের মারধর করছে। আমরা এখানেও জ্বালাব।
রহমতুল্লাহ ফোনে কোনরকমে জানায় ” আমাকে ওরা মেরেই ফেলবো, পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে, গোটা শরীরে খুব ব্যাথা হচ্ছে। চোখ ভাল হবে কি না জানি না”।
সিপিডিআর এর নেতা অবসরপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষক জিয়াগঞ্জে তাঁর বাড়িতে বসে জানান,” জিয়াগঞ্জের অবস্থা খুব খারাপ। এখানে ঘোষেরা খুব সংগঠিত। আমার অনেক ছাত্র আছে। আজ তারা এমন আচরণ করে আমার খুব লজ্জা লাগে। তার ছাড়াও সামগ্ৰিক ভাবে ব্যতিক্রম ছাড়া হিন্দুরা বিজেপির মতো কথা বলে। বামপন্থীদের অবস্থাও কি একই রকম এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন তাঁরাও ছদ্মবেশী। বিজেপি সরকারে আসার পর মুখোশ খুলে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন তৃণমূলের হিন্দুরা তো দিনে তৃণমূল, আর রাতে বিজেপি। মাধব ঘোষের ছেলে প্রসেনজিৎ ঘোষ এখন তৃণমূলের কাউন্সিলর। দিনে তৃণমূলের কাউন্সিলর। রাতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা। এদের নেতৃত্বেই জিয়াগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ঘোষেরা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনে যুক্ত। তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মিলিত শক্তিকে ধ্বংস করে হিন্দু মুসলমানের ঝামেলা তৈরি করার জন্য এ সব করছে। এখানে ছাগলের মাংস ৮০০ টাকা কেজি আর গরুর মাংস ২৫০ টাকা কেজি। তারা সস্তায় মাংস খাচ্ছে, এতে অন্যের আপত্তি বেআইনি।” তবে পুলিসি তৎপরতার জন্য পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া গেছে। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন মহল ও রাজনৈতিক দল এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
উল্লেখ্য, জিয়াগঞ্জের ভট্টপাড়া এলাকা হিন্দুত্ববাদীদের শক্ত ঘাঁটি বলে স্থানীয়রা জানান।
খুলনা গেজেট/এএজে